ফেরারি রাজপুত্র – বুক রিভিউ

ফেরারি রাজপুত্র – গালীব বিন মোহাম্মদ

সাহিত্য জগতে অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য গল্পের প্রতি পাঠকদের সবসময়ই আলাদা আকর্ষণ থাকে। আর যদি সেই গল্পে থাকে দুঃসাহসিক অভিযান, বুদ্ধিমত্তার লড়াই ও উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি, তাহলে সেটি আরও বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তেমনি “ফেরারি রাজপুত্র” গালীব বিন মোহাম্মদ-এর এক চমৎকার সৃষ্টি। এটি শুধুমাত্র একটি বই নয়, বরং এটি এক নতুন চিন্তার জগতে প্রবেশের গন্তব্য বলা যায়। “ফেরারি রাজপুত্র” বইটি আপনাকে আপনারা জীবন সম্পর্কে ভাবাবে। আপনার জীবনকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং নিজের জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবার খোরাক জোগাবে। 

“ফেরারি রাজপুত্র” বইটি মূলত অ্যাডভেঞ্চারধর্মী উপন্যাস। রহস্যময় পরিবেশ, উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ও দুঃসাহসিক চরিত্রের উপস্থিতির কারণে বইটি পাঠকদের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার যোগ্য। 

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যাকে সবাই “ফেরারি রাজপুত্র” হিসেবে চিনে। কিন্তু কে এই ফেরারি রাজপুত্র? কোথায় তার বসবাস? কি তার আসল পরিচয়? আর কেনই বা তিনি একজন ফেরারি রাজপুত্র হয়ে গেলেন? কি তার অপরাধ? এবং তার বিরুদ্ধে কি-ই বা ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো? কারা এবং কেন করেছিলো? এই রকমই কিছু প্রশ্নের উত্তর ধাপে ধাপে সাজানো আছে এই বইয়ে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলেই প্রবেশ করতে হবে গালীব বিন মোহাম্মদ-এর রোমাঞ্চকর অনবদ্য সৃষ্টি “ফেরারি রাজপুত্র” বইয়ের মধ্যে।

“ফেরারি রাজপুত্র” বইটির মূল বিষয়ঃ

“রাখে আল্লাহ, মারে কে?” 

আল্লাহ সকল ক্ষমতার উর্ধ্বে। তিনি চাইলে তার বান্দাকে এক নিমিষেই শেষ করে দিতে পারেন। আবার তিনি চাইলেই তার বান্দাকে মৃত্যুর দূত হয়রত আজরাইল (আঃ)-এর হাত থেকেও রক্ষা করতে পারেন। তিনিই সর্বশক্তিমান। “ফেরারি রাজপুত্র” বইয়ের নায়ক সবসময়ই আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছেন। আল্লাহর উপর আস্তা রেখেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বেরিয়েছেন এক অজানা অচেনা অভিযানে। 

গল্পের শুরুই হয় একটি উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে। যেখানে আমরা দেখতে পাই গল্পের নায়ক কোনো এক বিশেষ কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার পেছনে ছায়ার মতো লেগে আছে কিছু অজানা শত্রু। সেই শত্রুপক্ষ ধরতে পারলেই তার বিনাশ করে দিবে। নিশ্চিহ্ন করে দিবে তার নাম ও নিশান এই সুন্দর ধরণীর বুক থেকে। 

আমরা সাধারণ জানি যিনি রাজপুত্র হয়, তার জন্মই হয় এক সমৃদ্ধ রাজবংশে। ছোটবেলা থেকেই যাকে তার রাজ্য শাসন করার জন্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। এই গল্পেও অনুরুপ ঘটনাই ঘটছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমরা দেখতে পাই গল্পের রাজপুত্র হয়ে ওঠে এক ফেরারি, একজন পলাতক। যাকে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয় ছলচাতুরী, ছদ্মবেশ, লড়াই আর ধৈর্যের মাধ্যমে। 

আমাদের এই গল্পের নায়কই হলেন ফেরারি রাজপুত্র। যিনি উমাইয়াদ বংশের (বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে) সর্বশেষ রক্ত। যিনি হলেন দশম উমাইয়াদ খলিফা “হিশাম ইবনে আবদুল মালিক”-এর নাতি “আবদ-আল-রহমান (কিংবা আব্দুল আল-রহমান)”। যার বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর। এবং যাকে হত্যা করার জন্য হন্যি হয়ে খুঁজতে বের হয়েছিলো আব্বাসিদদের কালো পোশাক পরিহিত সৈন্যদল। 

আবদ-আল-রহমানের এই অভিযানে সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তার খুব কাছের বন্ধু গ্রিস দেশীয় মুসলমান “বদর”। আবদ-আল-রহমান এবং বদর কীভাবে নিজেদের রক্ষা করে গেছেন শত্রুদের হাত থেকে? কীভাবে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হলেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে? কীভাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন? কীভাবে একটা ছোট্ট হাত মোজার মতো সামান্য বস্তুও মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে? কীভাবে একজন বন্ধু তার সত্যিকারের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারে? কীভাবে বার বার শত্রুদের হাত থেকে আল্লাহ তায়ালা তাদের রক্ষা করেছেন? কীভাবে তিনি আন্দালুসের শাসক হলেন? কীভাবে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন? কিভাবে তিনি আব্বাসিদ বাহিনীর প্রধান “ইবনে মুগিত”-এর মস্তক তার দেহ থেকে ছিন্ন করে আব্বাসিদ খলিফা “আল-মনসুর”-এর জন্য উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছেন? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর রয়েছে “ফেরারি রাজপুত্র” বইটিতে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য বইটি পাঠককে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে ধরে রাখবে। 

“ফেরারি রাজপুত্র” বইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্যঃ 

লেখক প্রতিটি চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠককে বাস্তবতার অনুভূতি দেয়। বিশেষ করে প্রধান চরিত্রের নেতৃত্বদান, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দ্বিধা, সংকট ও বিকাশ অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় টানটান উত্তেজনাপূর্ণ, যা পাঠককে শেষ না করা পর্যন্ত থামতে দেয় না। এছাড়া লেখক যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেগুলো আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাই পাঠক বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারবে। 

ফেরারি রাজপুত্র
“ফেরারি রাজপুত্র” বইটি পড়তে ছবিতে ক্লিক করুন!

লেখার ধরণ এবং উপস্থাপনাঃ

গালীব বিন মোহাম্মদ-এর লেখনশৈলী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তার বর্ণনাশক্তি এতটাই প্রাণবন্ত যে পাঠক বইয়ের প্রতিটি দৃশ্য যেন চোখের সামনে দেখতে পান। লেখকের ভাষা সুস্পষ্ট, সাবলীল এবং প্রাঞ্জল। ঐতিহাসিক পটভূমির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি দারুণ দারুণ শব্দ চয়ন করেছেন, যা কাহিনির আবহ তৈরি করতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে এমন টানটান উত্তেজনাময় চমক আছে, যা পাঠককে বাধ্য করে পরবর্তী অধ্যায়ে যেতে। 

বিশেষ করে কারা “ফেরারি রাজপুত্র” বইটি বেশ উপভোগ করবেনঃ 

১. যারা ঐতিহাসিক উপন্যাস পছন্দ করেন। 

২. যাদের রাজনৈতিক থ্রিলারের প্রতি আগ্রহ বেশি। 

৩. যারা ষড়যন্ত্র ও প্রতিশোধমূলক কাহিনি উপভোগ করেন। 

৪. যারা রাজনীতি ও ক্ষমতার লড়াই নিয়ে লেখা বই পছন্দ করেন। 

৫. যারা এমন এক গল্প খুঁজছেন, যা শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত ছাড়তে পারবেন না। 

সীমাবদ্ধতাঃ

যদিও বইটি অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক, তবে কিছু পাঠকের কাছে এটি কিছুটা পুনরাবৃত্তিমূলক মনে হতে পারে। বিশেষ করে, যারা আত্মউন্নয়নমূলক বই পড়তে অভ্যস্ত, তাদের জন্য কিছু বিষয় পূর্বপরিচিত লাগতে পারে। আবার কাহিনির কিছু অংশে অতিরিক্ত বর্ণনা গল্পের গতি কমিয়ে দিয়েছে। তবে যারা নতুনভাবে জীবনকে দেখতে চান, তাদের জন্য “ফেরারি রাজপুত্র” বইটি নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার একটি বড় উৎস হতে পারে। 

শেষ কথাঃ 

“ফেরারি  রাজপুত্র”  নিছকই একটি উপন্যাস নয়, বরং এটি একজন শাসকের জন্ম, একজন শাসকের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের অভিযান, পৃথিবীর বুকে টিকে থাকার লড়াই, এক দুর্দান্ত নতুন ইতিহাস সৃষ্টির রূপক। গল্পের গভীরতা, নাটকীয়তা এবং লেখকের অসাধারণ বর্ণনাশৈলী এটিকে পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য করে তুলেছে। 

যদি আপনি এমন একটি উপন্যাস খুঁজে থাকেন, যা আপনাকে ইতিহাসের এক অন্যরকম জগতে নিয়ে যাবে, তাহলে “ফেরারি রাজপুত্র” অবশ্যই আপনার জন্য সেরা পছন্দ হবে। এটি আপনাকে ভাবাবে, চ্যালেঞ্জ করবে এবং নিজের জীবন সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করাবে। যারা নিজেদের জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে চায়, পরিবর্তন আনতে চায় এবং সত্যিকারের স্বাধীনতা খুঁজতে চায়, তাদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। 


  • বইঃ ফেরারি রাজপুত্র
  • লেখকঃ গালীব বিন মোহাম্মদ 
  • প্রকাশকঃ আদর্শ
  • প্রকাশকালঃ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৯/১০
  • রিভিউ লিখেছেনঃ বায়েজীদ বোস্তামী শুভ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *